বিশ্বাস হচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। মনে হচ্ছে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি, ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন- হয়ত এখনই ঘুমটা ভেঙ্গে যাবে আর এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পাব আমি। কিন্তু না, এটা দুঃস্বপ্ন নয়। স্বপ্নে স্পর্শের অনুভূতি থাকে না। আইসিইউর করিডোরে মাহাবুব এসে যখন আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, “রূপকের অবস্থা ভালো ঠেকছে না রে!” হৃৎপিন্ড দিয়ে তখন একটা শিরশিরে অনুভূতি বয়ে গেল আমার। কিছুদিন আগেই ক্যাম্পাসে ওর সাথে একটা বিষয় নিয়ে ভীষণ ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল, একপর্যায়ে আমি রূপকের গায়ে হাতও তুলেছিলাম। বেচারার কোনো দোষ ছিল না। শাফকাত বাহিনীর পাল্লায় পড়ে আমি বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম, ওর থেকে একটা দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিলাম। বিষয়টা কতবার বুঝাতে চেয়েছে ও, আমি পাত্তা দেইনি। এখন বারবার শুধু অনুশোচনা হচ্ছে।
করিডরের ওয়েটিং চেয়ারে বসে পুষ্পিতা অবিরত দোয়া-দরুদ পড়ে যাচ্ছে। রূপকের চাকরিটা হয়ে গেলেই ওদের বিয়ে হবার কথা ছিল। নতুন জীবনে প্রবেশের মানসিক প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছিল দু’জনে। সবকিছু কি এখানেই থেমে যাবে? বিধ্বস্ত মেয়েটাকে সঙ্গ দিচ্ছে আয়েশা ভাবি।
মাহাবুব একটু আগে রূপকের বাড়িতে ফোন দিয়েছিল। আঙ্কেলকে সবকিছু খুলে বলা হয়নি, বলার সাহস হয়নি ওর। তিনি হয়তো এতক্ষণে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছেন। আমরা সবাই এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে, এখানে এসে সবকিছু জানার পর তিনি কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন- আমরা তাকে কীভাবে সামলাবো, নিজেরাই যেখানে বিপর্যস্ত!
সময়ের এক একটি মুহূর্ত আর রূপকের এক একটি হৃৎকম্পন যেন একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে। ক্রিয়া সংঘটিত হচ্ছে আইসিইউর ভেতর, আর প্রতিক্রিয়া চলছে আমাদের মনে। সম্পর্কের সূত্রগুলো বোধহয় এভাবেই আন্দোলিত করে মানবাত্মাকে।
আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে একই সাথে যাত্রা শুরু হয়েছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের। জহিরুল ইসলাম রূপক নামের ছেলেটিকে সেদিন আমাদের ভালো তো লাগেইনি, বরং বিরক্তিকর মনে হয়েছিল। কিন্তু সে ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে সহপাঠীর সীমারেখা ছাড়িয়ে ও কবে যে আমাদের অতি প্রিয় বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল, খেয়াল নেই কারোরই। শুধু আমাদের কেনো, ডিপার্টমেন্টের সবার। তবে মঈন স্যার কেনো যেন রূপককে পছন্দ করতেন না। আমরা যেখানে মারাত্মক রসিকতা করলেও তিনি কিছু বলতেন না, সেখানে ও সামান্য হাসি-ঠাট্টা করলেও ওকে ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতে বলতেন। রূপক চাইলেই পারত রূঢ়তার বিনিময়ে রূঢ়তা দিতে। কিন্তু ও সেটা করেনি। যেদিন ক্লাস নিতে এসে মঈন স্যারের প্রেসার হটাৎ বেড়ে গেল এবং তিনি মাথাঘুরে পড়ে গেলেন, সেইদিন স্যারকে তার কোয়ার্টারে পৌঁছে দেয়া থেকে শুরু করে ডাক্তার দেখানো পর্যন্ত সব কাজ ও একাই করেছিল। স্যারের কোনো ছেলে ছিল না। সেই ঘটনার পর থেকে স্যার ওকে নিজের ছেলের মতোই দেখতেন। মঈন স্যার এখন অবসরে আছেন। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তার ছেলের এই পরিস্থিতির কথা শুনলে তিনি সবকিছু ফেলে ছুটে আসতেন। সবচেয়ে অবাক হয়েছি আমরা আজকে, যখন রূপকের রক্তাক্ত শরীর দেখে এই হাসপাতালেরই এক আয়া হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ও নাকি গত তিন বছর ধরে তার ছেলেটাকে স্কুলের বই-খাতা কিনে দিয়ে আসছে!
এভাবে আন্তরিকতা আর সহমর্মিতা বিলিয়ে যে ছেলেটি কাছের-দূরের সবাইকে আপন করে নিতে পারে, সেই ছেলেটিকে ওরা কীভাবে তিনতলা থেকে ফেলে দেয়? কী দোষ করেছিল ও? অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিল- এই? সমাজসেবার মুখোশ পরে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে যারা নিরীহ শিক্ষার্থীদের শোষণ করে তাদের বিরুদ্ধে বিবেকটাকে জাগ্রত করেছিল- এটাই কি ওর দোষ ছিল? ভীষণ আত্মগ্লানিতে ভুগছি আজ, মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রয়োজনে যে সবার আগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসত, তার সংগ্রামে আমরা তাকে সঙ্গ দেইনি- এর চেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা আর কি হতে পারে!
ভাষার প্রতি ভীষণ ভালোবাসা ছিল ওর। বলতো, “আরে, এই ভাষা দিয়েই তো আমরা মনের জমানো অনুভূতিগুলো চারদিকে ছড়িয়ে দেই, ঠিক যেমন একজন শিল্পী তার ভাবনাগুলো ছড়িয়ে দেন আপন শিল্পকর্মের মধ্যমে।” এই ভালোবাসাই ওকে মাহাবুবের লেখা রোম্যান্টিক কবিতাগুলো পড়তে উৎসাহিত করত, শুদ্ধ বাংলা সংগীতের প্রতি আগ্রহী করে তুলত, আর্ট এক্সিবিশনগুলোয় এক একটি চিত্রকর্মের নিগূঢ় তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টায় ব্যাপ্ত করত। আমাদের কাছে যেই চিত্রকর্মটা হয়তো তুলির সাহায্যে কয়েকটি রঙের আঁকিবুঁকি ছাড়া আর কিছুই নয়, সেই ছবিটা দেখেই ও কীভাবে যেন বলে দিত- এটি আসলে একটি বিমূর্ত মানব প্রতিকৃতি। ভাষার জ্ঞানকে শুধু নিজের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখতে নয়, বরং ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল ও। আর সেকারণেই সুবিধাবঞ্ছিত ছেলে-মেয়েদের একটি স্কুলে সপ্তাহে দু’দিন অক্ষরজ্ঞান দিতে যেত।
সেই ভাষাকে যখন শাফকাত বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল তখন আর শান্ত থাকতে পারেনি রূপক। ওদের কারণে ক্যাম্পাসে ইভ টিজিং, র্যা গিং, মাদকের ছড়াছড়ি, প্রশাসনিক অনিয়ম যখন চরমে, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন ওদের অস্ত্রের কাছে অসহায়, তখন ফেসবুক আর ব্লগে সেই যন্ত্রণার কথাগুলো তুলে ধরতে শুরু করল ও। ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়ায় শাফকাতের লোকজন রুমে এসে ওকে হুমকি দিয়ে গেল একদিন। রূপক তাতে দমে গেল না। আজ একুশে ফেব্রুয়ারির সমাবেশে শাফকাত যখন ভাষা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা নিয়ে এক বিরাট ভাষণ দিতে শুরু করল, তখন সবার সামনেই ওর দিকে জুতা ছুঁড়ে মারল ও। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলে বিস্মিত হলো। কিছু না শুনেই ওকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলে আখ্যায়িত করতে লাগল অনেকে। আমাদের ডিপার্টমেন্টের স্যাররা রূপককে ভালো করেই চিনতেন। তারা পরিস্থিতি শান্ত করতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু শাফকাত আর ওর লোকেরা শান্ত হলো না। রাতের দিকে খাবার টেবিলে অতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওর বাহিনী রূপককে চাপাতি দিয়ে জখম করে উপর থেকে ফেলে দিলো। আমরা তখন হলে ছিলাম না। এক জুনিয়র ফোন করে সব জানালো। দ্রুত ছুটে গিয়ে ওদের চোখ এড়িয়ে রূপককে হাসপাতালে নিয়ে এলাম দু’জনে মিলে। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন স্বচক্ষে দেখিনি, তবে সে সময় পাকিস্থানি শাসকগোষ্ঠী যেভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাঙালিদের কণ্ঠ রোধ করতে চেয়েছিল, শাফকাত আর ওর লোকজনও কি সেই একইভাবে আমাদের কণ্ঠ রোধ করতে চাইছে না?
রূপকের নোট বুকটা এখন আমার হাতে। ওকে ধরাধরি করে হাসপাতালে আনার সময় নোট বুকটা আমার হাতে এসে পড়ে, যে নোট বুকটা ও সবসময় যত্ন করে নিজের পকেটে রাখত। সুযোগ পেলেই কি যেন লিখত। আমরা জানতে চাইলে স্মিত হেসে ব্যাপারটা এড়িয়ে যেত। কারও অনুমতি ছাড়া তার ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোয় অনুপ্রবেশ করা অনুচিত। কিন্তু আজ ওর মনের কথাগুলো খুব জানতে ইচ্ছে করছে, খুব! বন্ধু হিসেবে আমি কি তা জানতে পারি না? সংকোচ ভুলে নোট বইয়ের কভার উল্টোলাম। লেখার প্রথম পাতায় উদ্ধরণ চিহ্নের ভেতর একটি লাইন-
“আকাশ বাড়িয়ে দাও...”
এরপর থেকেই শুরু। দিনলিপি নয়, বরং আত্মকথনের মতো করে লেখা-
ঢাকায় আসার আগে আমার পৃথিবীটা অন্যরকম ছিল, একেবারেই অন্যরকম। মাকে হারিয়েছিলাম খুব ছোট বেলায়। বদলির চাকরি হবার কারণে বাবাও বাড়িতে থাকতেন না খুব একটা। আমাদের সাথে থাকতেন নতুন মা। নতুন মাকে আমরা নিজের মায়ের মতো দেখলেও, তিনি কেনো যেন আমাদের নিজ সন্তানের মতো দেখতেন না। খুব ছোটবেলায় আমার সহপাঠীরা যখন নিজেদের আম্মুর হাত ধরে স্কুলে আসত, আমি তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদের দেখতাম। আমার হাত ধরার, আমাকে আদর করে বিদায় জানানোর কেউ থাকত না। টিফিন প্রিয়ডে বন্ধুরা যখন বাসার তৈরি খাবার খেত, আমাকে তখন ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের জন্য টিফিন কিনতে হতো। মাঝে মাঝে রাতেরবেলা একা ঘুমাতে খুব ভয় লাগত। খুব ইচ্ছে করত, মা’র পাশে গিয়ে একটু শুই, তার গলা ধরে ঘুমাই। কিন্তু পারতাম না! বাবা বাসায় না থাকলে আমাকে রান্নাঘরে গিয়ে একাই ভাত খেতে হত। আমার প্লেটে আদর করে ভাত তুলে দেয়ার, তরকারি বেড়ে দেওয়ার কেও থাকত না।
ক্লাস টেনে পড়ার সময় একদিন চেরাগ আলীর মোড়ে স্কুলের কিছু বখাটে সহপাঠী আমাকে অযথাই মেরেছিল, সেইদিন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়েছিল। রাতে প্রচণ্ড জ্বর এসেছিল ওইদিন। আমাকে তখন সঙ্গ দেয়ার, আমার মাথায় সহানুভূতির হাত বুলানোর কেও ছিল না।
বন্ধুদের মাঝে মাঝে যখন বাধভাঙ্গা আনন্দ করতে দেখতাম তখন হঠাৎ করে চুপ হয়ে যেতাম। ওরা জিজ্ঞেস করত, কী হয়েছে? আমি এর কোন যথার্থ উত্তর দিতে পারতাম না। কি বলতাম ওদের, আমি নিজেকে তোদের মতো প্রকাশ করতে পারি না? ক্রিকেটের প্রতি আমার অনেক ঝোঁক ছিল, এখনও আছে। একটা দামী ব্যাটের শখ ছিল খুব। বাবাকে কখনও সে শখের কথা জানাতে পারিনি আমি। মা থাকলে হয়তো আমার সে আবদারের কথা বাবাকে জানাত। কিন্তু আমি যে দুর্ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলাম!
বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পর শুরু হলো আমার নতুন জীবন। পৃথিবীটা বিস্তৃত হতে লাগলো, সেই সাথে আমিও। নিজের মাঝে একটা পরিবর্তন টের পেলাম, একটা অন্তর্মুখী তাগিদ আমাকে বদলাতে থাকল। ভালোবাসা আর স্নেহময় বুলির অভাব ছিল বলেই হয়তো অন্যের মাঝে সেটা ছড়িয়ে দিয়ে একটা অন্তর্মুখী তৃপ্তি অনুভব করতে লাগলাম। জীবনটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠল।
আর দশটা ছেলের মতো মায়ের ভালোবাসা আমি কখনও পাইনি, মায়ের মুখের মধুর বুলিগুলোও শুনিনি কখনও। তাতে কি? সে ভালোবাসা আমি অর্জন করে নিব- এই পৃথিবীতে না হোক, অন্য কোনো পৃথিবীতে...
শেষ বাক্যটি শেষ হবার আগেই আমার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো। আর কিছুই পড়তে পারলাম না। নিজের দুঃখ নিয়ে ভারাক্রান্ত হতে আমরা সকলেই জানি, কিন্তু অন্যের দুঃখকে প্রশমিত করে আত্মতৃপ্তি নিতে কি আমরা সবাই পারি?
রূপক তুই ফিরে আয়, হারিয়ে যাস না ওই না ফেরার জগতে, তোকে যে আজ আমাদের বড় দরকার। তুই না থাকলে কে ওই সুবিধাবঞ্ছিত শিশুগুলোকে মাতৃভাষার পাঠ শেখাবে, কে মাহাবুবের কবিতাগুলো এতো মনোযোগ দিয়ে পড়বে, কে প্রতিবাদ করবে অন্যায়ের? তুই না থাকলে কে পুষ্পিতাকে নিয়ে জীবনের রঙিন স্বপ্ন বুনবে? একবার চেয়ে দেখ, মেয়েটা কতোটা অসহায়ভাবে তোর পথ চেয়ে বসে আছে। রূপক, তুই ফিরে আয় দোস্ত! তোর কাছে যে এখনও আমার ক্ষমা চাওয়া বাকী আছে...
আমার ভাষা কি তুই শুনতে পাচ্ছিস, রূপক?